গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার কবলে হারিয়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বতন্ত্রতা ও আমেজ

0
612

হৃদয় সরকার: গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার কারনে একদিকে হারিয়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বতন্ত্রতা এবং অন্যদিকে হারিয়ে যাচ্ছে ভর্তি পরীক্ষা চলাকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের আমেজ।

গত দু’বছর পূর্বেও পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন গুলো আলোর শাড়িতে নিজেকে সজ্জ্বিত করতো। দেখে মনে হত যেন রাতের অন্ধকারে লাল পরি নীল পরি তাদের ভালবাসা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টাকে জাগিয়ে তুলেছে। কিন্তু গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার কারনে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কম হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভবন আর আগের মতো আলোর সাজে মেতে উঠেনা। কারন দর্শনার্থী ব্যতিত বাগানে ফুল ফোঁটার কোনো মূল্য থাকেনা।

একটা সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হত তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে ও বাহিরে আনন্দের উচ্ছ্বাস প্রবাহিত হত। এই আনন্দ যেমনটা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের, অন্যদিকে ছিল নবাগত ভর্তিচ্ছুক শিক্ষার্থীদের।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আনন্দের কারন ছিল তার এলাকা থেকে ছোট ভাই-বোনেরা পরীক্ষা দিতে আসবে। এতদূর থেকে তারা আসলে তাদেরকে কিভাবে ভালবাসা দিয়ে বরন করে নেওয়া যায়, কিভাবে তাদের যত্ন নেওয়া যায়, কিভাবে তাদেরকে ভর্তি পরীক্ষা সংক্রান্ত সকল ধরনের সেবা প্রদান করা যায়, এমনকি পরীক্ষা শেষে এলাকার ছোট ভাই-বোনদের নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যাওয়া। এসব চিন্তাভাবনা করতে করতে শিক্ষার্থীরা আনন্দে মেতে উঠতো।

এমনকি পরীক্ষা শুরু হবার দু’দিন পূর্ব থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেইট থেকে শেষ গেইট পর্যন্ত প্রত্যেক জেলা ভিত্তিক ছোট ছোট স্টল তৈরি করা হত। এসব স্টলের মাধ্যমে নিজ জেলা থেকে আগত ছোট ভাই-বোনদের সহযোগিতা প্রদান করাই ছিল মূল লক্ষ্য।

অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা নিজ জেলা তথা নবাগত শিক্ষার্থীদেরকে রাতে ঘুমানোর জন্য নিজের বেড ত্যাগ করে ক্যাম্পাসেই রাত কাঁটাতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার সময়ে এমন হাজারো স্মৃতি মনে পরে যায়। কিন্তু সে স্মৃতিগুলো মনের আঙ্গিনায় ঠাঁই পাওয়া ব্যতিত অন্য কোথাও জায়গা করে নিতে পারবেনা।

এসব কারনে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার পক্ষে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রবল বেগে হতাশা কাজ করছে৷ যার অনেকগুলো কারনের মধ্যে অন্যতম কয়েকটি কারন হচ্ছেঃ বিশ্ববিদ্যালয় তার স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলছে, স্বপ্নাতীত বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা হবেনা, যার কারনে শিক্ষার্থীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াতে পারবেনা, পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে নিজ জেলা এসোসিয়েশনের কার্যক্রম পরিচালনায় তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারবেনা এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের চরম উপলব্দির দিনটি তারা আর কখনো ফিরে পাবেনা।

অন্যদিকে বিবেচনা করলে দেখা যায়, একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজের কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য থাকে। যেগুলোর কিছু অংশ ভর্তি চলাকালীন সময়ে দেখা যায়৷ যার মধ্যে অন্যতম বিশ্ববিদ্যালয়ের হল সমূহ, যাতায়াত ব্যবস্থা এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভবনের কার্যক্রম। তার সাথে সাথে লক্ষ্য করা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক কিছু নিদর্শন, যেগুলো দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আশা নবাগত শিক্ষার্থীদেরকে আকৃষ্ট করে থাকে। কিন্তু গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার কারনে জেলা ভিত্তিক পরীক্ষার সিট স্থাপন করা হয়, যার কারনে দূর থেকে শিক্ষার্থীরা তার স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পরীক্ষা দিতে পারেনা এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বকীয়তা সম্পর্কে তেমন কোনো ধারন লাভ করতে পারেনা। যার কারনে তাদের স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি ভালবাসা কিছুটা কমে যায়।

অন্যদিকে বিবেচনা করলে দেখা যাবে, গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার কারনে দেশের নতুন বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর তুলনায় পুরাতন বিশ্ববিদ্যালয় গুলো মেধা তালিকার শীর্ষ শিক্ষার্থীদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে৷ যার কারনে অপেক্ষমান নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কম মেধাবী শিক্ষার্থীরা ভর্তি হচ্ছে৷ যার ফলে এসব নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জাতীয় মেধাশক্তি উৎপন্ন করতে পারেনা। যার ফলাফল পেতে সুদূর ভবিষ্যতের দিকে তাকালে বুঝা যাবে এসব নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একটা সময় “বিশ্ববিদ্যালয়” নামক স্থানের যথাযথ মূল্য দিতে পারবেনা, কারন তাদের কাছে যথাযথ মেধা শক্তি নেই। যার সর্বশেষ ফলাফল হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়কে যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হবেনা এমনকি বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর পরিস্থিতি একটা সময় বর্তমান ভারতের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ন্যায় হয়ে যাবে। যেখানে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে আগ্রহ কমে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দিকে ঝুঁকি বাড়বে৷ এবং আমরা লক্ষ্য করলে দেখতে পাবো, দেশের কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী এখন থেকেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোে দিকে অগ্রসর হচ্ছে। যার প্রধান কারন হলো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের মান ধরে রাখতে পারছেনা। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে আগামী দুই দশক পরে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার মতো শিক্ষার্থী খুঁজে পাওয়া যাবেনা।