১৮ বছর ধরে খেয়া ঘাটের নৌকায় চপলা রাণীর সংসার

0
313


সাকিব আহমেদ, হরিরামপুর (মানিকগঞ্জ):নাম তার চপলা রানী দাস। স্বামী মারা গেছেন ১৫ বছর আগে। তিন বছর অসুস্থ থেকে তার স্বামী মারা যান। ১৮ বছর আগে ওই সময়ে চার সন্তান নিয়ে বিপাকে পরে যান তিনি। হয়ে যান খেয়া ঘাটের মাঝি। ছোট ছেলেকে কোলে নিয়ে নৌকার বৈঠা ধরেছেন। এভাবে ১৮ বছর ধরে নৌকা চালিয়ে সংসার পরিচালনা করেছেন তিনি। নামের সাথে রানী থাকলেও জীবন যুদ্ধে খেয়া ঘাটের মাঝি হয়ে জীবন চলছে তার। মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের ঝিটকা নতুন বাজার থেকে গোপীনাথপুর বটতলা (মনু পীরের মাজার) ইছামতী নদীতে মানুষ পারাপার করেন তিনি।


স্থানীয়রা জানান, গোপীনাথপুর মজমপাড়া, উত্তরপাড়া, উজানপাড়া, কদমতলী, কুটির বাজার, মোহাম্মদপুর, কোটকান্দি, কুশিয়ারচরসহ অনেক এলাকার মানুষ এই ঘাট দিয়ে যাতায়াত করত। স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীরাও ঘাট পার হয়ে স্কুল কলেজে আসা যাওয়া করত। কয়েকবছর আগে ঝিটকা- গোপীনাথপুর- বাল্লা সড়কটি পাকা হলে এ ঘাটে পারাপারের চাহিদা নেই বললেই চলে। ৫ বছর আগে এই ঘাট দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার লোকের যাতায়াত হলেও বর্তমানে দুইশো থেকে তিনশো লোকের বেশি যাতায়াত হয়না।

গ্রামবাসী থেকে আরো জানা যায়, পঞ্চাশোর্ধ বয়স্ক চপলা রাণী দাস উপজেলার গোপীনাথপুর ইউনিয়নের গোপীনাথপুর উত্তরপাড়া গ্রামের মৃত সুবাস চন্দ্র দাসের স্ত্রী। দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে তার।
বড় মেয়ে স্বরস্বতী রাণী দাস বিয়ে হয়েছে অনেক আগেই। বড় ছেলে সঞ্জীব চন্দ্র দাস পেশায় কাঠমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করে টাংগাইলে। বউ নিয়ে সেখানে থাকেন। ছোট মেয়ে ও ছোট ছেলেকে নিয়ে স্বামীর রেখে যাওয়া চার শতাংশ জায়গার ওপর প্রায় পনের বছর আগে কারিতাসের দেয়া একটি ঘরে বসবাস করেন চপলা রাণী । ঘরটিও টাকার অভাবে মেরামত করতে না পারায় জরাজীর্ণ অবস্থায় বাস করতে হচ্ছে তাকে।


নতুন বাজারের ব্যবসায়ী রাজিব জানান, “রাস্তাঘাট উন্নয়ন হওয়ায় এই ঘাটে এখন মানুষ পারাপারের চাপ নেই। ফলে খেয়া নৌকায়ও আগের মত আয় রোজগার নেই। তারপরেও টুকটাক যা হয়, এই দিয়েই মহিলা খুব কষ্ট করে চলে। ছোট ছেলেটাকে কোলে নিয়ে খেয়া পারাপার করতেও দেখেছি আমরা। স্বামীর মৃত্যুর পর এই খেয়া নৌকায়ই ছিল তাঁর জীবীকার একমাত্র অবলম্বন। নদীর পাড়ে টং ঘর তোলে সারারাত নদীর পাড়েও কাটিয়েছেন মানুষ পারাপারের জন্য।”




চপলা রানীর ছেলে আকাশ চন্দ্র দাস জানান, “শিশুকালেই বাবাকে হারিয়েছি। আমার মা এই নৌকা চালিয়েই আমাকে বড় করেছে। আমি ও আমার ছোটবোন গোপীনাথপুর উত্তর পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছি। টাকার অভাবে আর পড়াশোনা করতে পারিনি। ছোট বোনটির এখন অনেকটা বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের যে অর্থনৈতিক অবস্থা তাতে খুব চিন্তায় আছি। পড়াশোনা করতে না পারায় আমি ছোটবেলা থেকেই মাকে খেয়া ঘাটে সহযোগিতা করতাম। বর্তমানে নতুন বাজারের কাঁচামালের ব্যবসায়ী শফি ভাইয়ের মাধ্যমে কুটির বাজারে কাঁচা মালের ব্যবসা করি। বাজার ভাঙ্গার পরে আমি বেলা ১১টা থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত এই খেয়া ঘাটে নৌকা চালাই। আর সকাল ৬টা থেকে সকাল ১১টা পর্যন্ত আমার মা নৌকা চালায়। মূলত আমরা মা ছেলে মিলেই যে যখন পারি এই খেয়া চালাই। ”


খেয়া ঘাটের আয়ের ব্যাপারে আকাশ চন্দ্র দাস বলেন, “গোপীনাথপুর গ্রামের তিনটি পাড়া থেকে বছরে ১২/১৩ মন ধান পাই। আর এছাড়া প্রতিদিন পারাপারে ৫০/ ৬০ টাকার মতো আসে। আগে এর চেয়ে বেশি হতো। বর্তমানে রাস্তা ঘাট ভাল হওয়ায় এ পথে মানুষজন তেমন আসে না।”


চপলা রাণী দাস জানান, “আমার স্বামী জীবিত থাকা অবস্থায় ও খেয়া নৌকা চালিয়েছি। অসুস্থ হয়ে তিন বছর ঘরে পড়ে থাকার পর সে মারা যায়। শিশু সন্তান নিয়ে এই খেয়া চালিয়েই অনেক কষ্টে এ পর্যন্ত টিকে আছি। এখন পারাপারের লোকজন তেমন হয় না। সকালে বাজারের সময় কিছু লোক পার হয়। গোপীনাথপুর গ্রামের মানুষ প্রতিবছর ধান দেয়। ঈদের মাঠ থেকেও কিছু টাকা পয়সা তারা উঠায় দেয়। তাদের সহযোগিতায়ই বেঁচে আছি। এছাড়া বিধবা ভাতার একটা কার্ড পাইছি। সবমিলিয়ে কোনো রকমে চলে। তবে আমার বড় সমস্যা হলো একটা মাত্র ঘর । অনেক আগে কারিতাসের একটা ঘর পাইছিলাম। তাও এখন টিন নষ্ট হয়ে গেছে। বৃষ্টি হলেই পানি পড়ে। তাই সরকারিভাবে একটা ঘর পাইলে দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে কোনো রকম থাকবার পারতাম।”

এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: সাইফুল ইসলাম মুঠোফোনে জানান, শিগগিরই চপলা রানীকে সরকারি সহায়তা দেয়া হবে।